সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া চিত্রনায়িকা পরীমণি ও ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন শিথিলের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি, ভিডিও সেইসাথে মৃত কলেজ ছাত্রী মুনিয়া ও জেকেজির ডা. সাবরিনার ব্যক্তিগত জীবনের ভিডিও সব প্ল্যাটফর্ম থেকে সরানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। বুধবার ২৫ আগষ্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাসমিয়া নুহাইয়া আহমেদ এ রিট দায়ের করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে সাকলায়েন ও পরীমণির ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এক মিনিটি ৫৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটিতে দেখা গেছে, সাকলায়েনের জম্মদিনে কেক কাটছেন তারা। পরে পরীমণি তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। পরে সাকলায়েনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে দেখা গেছে পরীমণিকে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সুশীল সমাজেও নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে।
আমাদের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সংবিধান একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিলেও সেটি উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টেলিফোনে আড়ি পাতা, কারো ফোনালাপ পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করে তা প্রকাশ করার ঘটনা রীতিরকম আইনবিরোধী। ব্যক্তি, রাজনীতিক ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কারোরই গোপনীয়তার অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না। ফেসবুকেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এ অপরাধের জন্য দুই বছর কারাদ- এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। আইনটি শুধু কাগুজে কলমে। কারণ এ অপরাধে আমাদের দেশে কারো শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল।
দেশে ফোনকলে আড়ি পাতা এবং তা প্রকাশ ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত সবার জন্যই নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করে এর ৭১ ও ৯৭ ক ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার জন্য এ কাজের বৈধতা দেওয়া হয়। আইন অনুসারে এসব কাজের জন্য সংস্থাগুলোক কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া অন্যান্য অ্যাপসের কল পর্যবেক্ষণে আনা সম্ভব হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আড়ি পাতা বিষয়ে এক রায়ে ‘আড়ি পাতা ব্যক্তির গোপনীয়তায় একটি মারাত্মক আগ্রাসন’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খেয়াল-খুশিমাফিক আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবে না। ১৯৯৬ সালে পিইউসিএল বনাম ভারত মামলায় বিচারপতি কুলদীপ সিং ও এস সগির আহমেদের মাইলফলক ওই রায়ে বলা আছে, কোনো রেকর্ডের কতটি অনুলিপি হবে, কতটুকুর ট্রান্সক্রিপশন হবে, কে কে দেখতে পাবেন, সেসব প্রাথমিক অনুমতির আদেশেই নির্দিষ্ট করতে হবে।
জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না। আমাদের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকেরই চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে।
ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনের অধিকারের মতোই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখাও একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। কেউ এমনটা করলে অন্যের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী হবেন এবং আপনার বিরুদ্ধে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন রিট করা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই। বর্তমানে যেসব আইন রয়েছে এর মধ্যেই গোপনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা-অধিকারের মধ্যে রয়েছে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য, অসুস্থতাজনিত তথ্য, যোগাযোগ তথ্য (যেমন-ফোন, মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র) ইত্যাদি। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্য যেমন-জিনগত পরীক্ষা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্যও গোপনীয়তা অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যোগাযোগের গোপনীয়তার মধ্যে রয়েছে চিঠি, টেলিফোন, ই-মেইলসহ যোগাযোগের সব ধরনের মাধ্যমের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা। ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাগম স্থান প্রভৃতি জায়গায় অন্যের অবৈধ অনুপ্রবেশকে সীমাবদ্ধ করাও ব্যক্তির গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। যেমন তল্লাশি, ভিডিও নজরদারি, পরিচয়পত্র যাচাই ইত্যাদি।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন। এর মাধ্যমে নারীদের উত্তক্ত্য করা ও তাদের অগোচরে প্রতারণার সুযোগে অশ্লীল ছবি ও ভিডিওচিত্র ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, ‘বিয়ের প্রলোভন দিয়ে স্কুলছাত্রীর নগ্ন ভিডিও ধারণ, ‘ধর্ষণের দৃশ্য মুঠোফোনে, প্রেমিকের সাথে ফোনালাপ ফাঁস ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি কোন পর্যায়ে গিয়ে, কোথায়, কতটা তথ্য প্রদান করবেন সেক্ষেত্রে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের প্রাধান্য এবং অধিকার থাকা উচিত। ব্যক্তিগত তথ্য কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে এবং কী পরিমাণে ব্যবহার করা বা প্রয়োগ করা হচ্ছে বা হয়েছে তা দেখার, জানার এবং জিজ্ঞাসা করার আইনি অধিকার ব্যক্তির থাকা উচিত। কারণ নজরদারি বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করে। সমাজবিজ্ঞানীরা নজরদারিকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ মানুষের ব্যক্তিগত অডিও, ভিডিও, ছবি, রিপোর্ট প্রকাশ’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে- সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। Email: seraj.pramanik@gmail.com,