এক কিশোরের দেখা মুক্তি যুদ্ধ ও ৮ ডিসেম্বর
খন্দকার জালাল উদ্দীন
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ১০ বছরের এক কিশোরের দেখা মুক্তি যুদ্ধ বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজনে আসলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনে দেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়াদেয়. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষন স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অসাধারণ কবিতা। কবি যখন বললেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। দেশের স্বাধীনতা কামী মানুষ যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে মুক্তির যুদ্ধে নেমে পড়ে, দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন পণ যুদ্ধ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ঘোষনা হল।
জুন-জুলাই থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়, সাধারণ মানুষের উপর পাকসেনা ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অত্যাচার বৃদ্ধি পেতে থাকে। হত্যা-নারী ধর্ষণ, নির্মম ভাবে গুলিবর্ষণ,লুট এলাকার মানুষকে আতংকিত করে তুলে, মানুষ জীবন বাঁচাতে দলে দলে সহায় সম্বল ফেলে রেখে প্রাগপুর সিমান্ত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, সে দৃশ্য ছিল করুন ও হৃদয় বিদারক।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে মুুক্তি যোদ্ধার সংখ্যাছিল ১১৪২ জন। দৌলতপুর ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়, দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর ৮ ডিসেম্বর দৌলতপুর হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে আদাবাড়িয়ার ব্যাঙগাড়ীর মাঠ, পিয়ারপুর ইউপি’র শেরপুর, চিলমারী ইউপি’র বাজুমারা, ফিলিপনগর, রামকৃষ্ণপুর ইউপি’র মহিষকুন্ডি, খলিশাকুন্ডি, হোগলবাড়িয়া ইউপি’র তারাগুনিয়া ও চামনায়,
বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই দিনে পাকিস্তানী হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্বসর্মপন করে এবং দৌলতপুর হানাদার মুক্ত হয়, থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উড়ানোর মধ্যদিয়ে মুক্তিকামী বীর সূর্য সন্তানেরা দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করেন। দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের মোট ১৬টি সম্মুখ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।
তৎকালিন দৌলতপুর থানায় পাক হানাদারদের সাথে সব চেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ১৯ নভেম্বর, আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ব্যাঙ গাড়ী মাঠে, সেখানে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২ জন মিত্র বাহিনীর সদস্য শহিদ হন, এ যুদ্ধে ৩ শতাধিক পাক সেনা নিহত হয়।
২৯ নভেম্বর পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর মাঠে পাক হানাদারদের সাথে আরো একটি বড় যুদ্ধ হয়। মরহুম মেহের আলির পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিব ও আমদহ গ্রামের সলেমান ফরাজীর পুত্র ওয়ারেশ আলি শহিদ হন, এ যুদ্ধে শতাধিক পাক সেনা ও দুই শতাধিক আলবদর-রাজাকার নিহত হয়। ভাগজোত মোড় এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ শহিদ হন, তারাগুনিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জেল হোসেন শহিদ হন, খলিশাকুন্ডি বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক শহিদ হন, এসব খন্ড যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। কয়েক দিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পাকসেনা ও রাজাকাররা দৌলতপুর থানার অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
৭ ডিসেম্বর পাকসেনারা রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়ে কুষ্টিয়া শহরতলীর জগতী বটতলী এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। দৌলতপুর থেকে পাকসেনারা পালানোর সময় রাত ৯টার দিকে মুক্তিবাহিনী চামনা-আল্লারদর্গা এলাকার বিএটিসি’র কাছে গতিরোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তুললে রাজাকার-পাকসেনার সম্মুখ যুদ্ধে ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামের মরহুম সামসুজ্জামান খাঁনের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক নিহত হন ও কয়েকজন এলাকাবাসী আহত হন। এলাকাবাসী তার লাশ তারাগুনিয়া বর্তমান রফিক নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে রাস্তার ধারে দাফন করেন।
তাঁর নাম অনুসারে এলাকার নাম ও স্কুলের নাম “রফিক নগর” নাম করণ করা হয়েছে এবং একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, প্রতিবছর এলাকাবাসী দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে।
এক উজ্জল প্রখর রোদ ছিল সেদিন, বিজয়ের দিন মুক্তিযোদ্ধারা এলাকার রাজাকার-আলবদদের বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বন্দি করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়।
দৌলতপুরে ১৯৭১ সালের সুমারী অনুযায়ী মুুক্তি যোদ্ধার সংখ্যাছিল ১১৪২ জন, এই বীরদের ছিলনা ভাল পোষাক, ভাল অস্ত্র, গাড়ীর ব্যবস্থা। রাতের আাঁধারে বন-জঙ্গল পেরিয়ে গোপনে পাক বাহিনীর অবস্থান ঠিক করে আক্রমনের পর তাদের ক্যাম্প দখল ও অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে ঐ অস্ত্র তাদের উপর ব্যবহার করতে হয়েছে। আমরা যুদ্ধে শহীদ ও বেঁচে থাকা বীরদের হাজার হাজার ছালাম ও শ্রোদ্ধা জানায়।